রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০১:০১ অপরাহ্ন
সাজেদ ফাতেমী:
‘এই বচ্ছর ভাছা আন্দোলনের ছত্তুর বছর হইল না রে! আবে ওই হালার পো মাইনক্যা, কতা কস না ক্যালা? কী রে, তরে যা জিগাই জবাব দে!’ কয়েকদিন আগে পুরান ঢাকার নবাবপুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় পাশের হোটেল থেকে ঠিক এই কথাটি ভেসে এলো কানে। মানিক নামের ছেলেটি তার মহাজনের কথার কোনো জবাব দিয়েছিল কিনা, জানি না। তবে আমার কানে সেই থেকে বেজে চলেছে ‘এই বচ্ছর ভাছা আন্দোলনের ছত্তুর বছর হইলো না রে!’ একদিন একটি অভিজাত খাবারের দোকানে ঢুকেছি। সেখানে সমানে উচ্চনিনাদে হিন্দি গান বাজছে। মিনিট পাঁচেক সহ্য করার পর এক ওয়েটারকে ডেকে বললাম ভাই, বাংলা গান বাজানো যায় না? সে বলল, ম্যানেজারকে বলেন। আমি উঠে ম্যানেজারকে বলতেই সে রাগত স্বরে বলে উঠল, এখানে বাংলা গান বাজানো নিষেধ। এখানে হিন্দির ডিমান্ড বেশি। আমরা সবাই জানি, আমাদের দেশে হিন্দি গানের, হিন্দি চ্যানেলের ও হিন্দি ছবির নায়িকাদের আদলে ড্রেসের ‘ডিমান্ড’ বেশি। আর কাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে এই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে, সেটাও আমাদের অজানা নয়। আমাদের অজানা শুধু একটাই হিন্দির এই ঘেরাটোপ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কী করে?
প্রতি বছর শহীদ দিবস এলে আমরা বাংলা ভাষার খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ফেব্রুয়ারি এলেই মনে পড়ে, ‘বাংলা’ নামে আমাদের একটি ভাষা আছে, যা মাতৃভাষাও বটে। হাজার হোক, মায়ের মুখ থেকে তো এই ভাষাতেই প্রথম বোল শিখেছি। তাই আমরা ‘মাতৃভাষা’, ‘প্রাণের ভাষা’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দযুগলের বন্দনায় মেতে উঠি। আর ঠিক ফেব্রুয়ারি পেরোতে না পেরোতেই সব ঠন ঠন। ভাষার প্রতি সব ভালোবাসা ফুস করে উড়ে এমন দূরে চলে যায়, এক বছরেও তার দেখা পাওয়া যায় না। ভাষার প্রতি সব প্রেম যেন ভেসে যায়। এটাই এখন আমাদের জাতীয় স্বভাব। এই স্বভাব বদলে দেবে, সেই সাধ্য কার?
আমাদের স্বভাব বদলাক আর না বদলাক, তাতে বাংলা ভাষার সত্যিই কী কিছু এসে যায়? এই বাংলায় বাংলা ভাষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কেউ টিকতে পারেনি। সামরিক শাসকও নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। আর কোথাকার কোন নাট্যকার জগাখিচুড়ি মার্কা বাংলা ভাষায় নাটক লিখে ফাটিয়ে দিল, কোন নির্দেশক উদভ্রান্তের মতো সেই ভাষার পক্ষে সাফাই গাইল কিংবা কোন গায়ক বাংলিশ উচ্চারণে গান গেয়ে তরুণীদের হৃদয় হরণ করল তাতে বাংলা ভাষার কি-ই বা আসে যায়?
যারা নিজের ভাষাকে এভাবে অপমান করছে, তারা নিজেরাও জানে এর পরিণতি ভালো নয়। তাই লোক দেখানোর জন্য হলেও ফেব্রুয়ারি এলে অন্যদের মতো তারাও হয়ে ওঠেন ভাষাপ্রেমী। প্রমিত বাংলা ভাষার দাবিতে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন। সবাই বাংলা ভাষার জন্য দরদ দেখাতে শুরু করেন। তখন স্বীকার করতেই হয়, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা বন্ধুশূন্য নয়। তবে ব্যতিক্রমী বিষয়টি হলো, বাংলা ভাষার বন্ধুর সংখ্যা সমাজের উচ্চস্তরে কম। মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষই এর প্রকৃত বন্ধু। তারা শুধু ভাষাটাকেই ধরে রাখেননি, বাংলা সনটাকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাদের অধিকাংশ কাজকর্ম বাংলা সন ধরেই চলে। কিন্তু দেশের আইন-আদালত থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ দপ্তরেই বাংলা ভাষা সরাসরি উপেক্ষিত। ভীষণ দুর্গতির মধ্যে পড়ে আছে আমাদের প্রাণের ভাষা। চিত্রটি আরেকটু স্পষ্ট করা যায় এ দেশের লোকগানের জনপ্রিয় দল নকশীকাঁথার এই গানের মধ্য দিয়ে আমার মাতৃভূমির মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার দুর্গতি/পড়ছে চোখে চারদিকে আজ চলছে এক তেলেসমাতি/আমরা মুখে বলছি ভালোবাসি নেই দলিল-দস্তাবেজে/বাংলা ভাষার বারোটা বাজে।- বাংলা ভাষার বারোটা বাজার বিষয়টি টের পাওয়া যায় অধিকাংশ উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের অবস্থা দেখলে। তারা ইংরেজিটা শিখলেই সাত খুন মাফ। তার যোগ্যতা যাচাইয়ের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় সে গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারছে কি না। এ ক্ষেত্রে হয়তো ইংরেজি শিক্ষকরা সার্থক। নকশীকাঁথার গানটির প্রথম অন্তরায় বলা হচ্ছে ‘বাপ-মায়ে খুশি দুগ্ধ শিশু বলছে যখন ইংরেজি/বস কলিগের পিঠ চাপড়ায় বলছে যখন ইংরেজি/শিক্ষক খুশি ছাত্র ক্লাসে বলছে যখন ইংরেজি/প্রেমিকার রূপ ঝাক্কাস লাগে বলছে যখন ইংরেজি/বাপ-মা বস টিচার প্রেমিকার বাংলা নাই কোনো কাজে/বাংলা ভাষার বারোটা বাজে।’
গানের দ্বিতীয় অন্তরায় তাই পিতা-মাতা, শিক্ষক থেকে শুরু করে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এভাবে ‘ও বাবা-মা সন্তানেরে বলতে বলেন বাংলাতে/ও বস সব সহকর্মীকে বলতে বলেন বাংলাতে/শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীকে বলতে বলেন বাংলাতে/ প্রেমিক প্রেমিকাকে বলতে বলেন বাংলাতে/ বাপ-মা বস টিচার প্রেমিকার বাংলা লাগুক সব কাজে/বাংলা তখন উঠিবে জেগে।’ তাহলে এ দেশে বাংলা বিষয়ের শিক্ষকদের অবস্থাটা কী? এই বিষয়ের শিক্ষকদের সবাই কি বিশুদ্ধ বাংলা লিখতে বা শেখাতে জানেন? তারা ভালো বাংলা জানলে চারদিকে এত ভুলবাক্য আর বানানের ছড়াছড়ি নিশ্চয় দেখতে হতো না। বাংলা ভাষার সর্বত্র প্রচলনের বিরোধিতাকারীরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন অন্য বিষয়গুলোর সব শিক্ষকও তো সেই বিষয়গুলো ঠিকঠাক মতো পড়াতে জানেন না। আমার জবাব বাংলা ভাষার সঙ্গে অন্য বিষয়গুলোর তুলনা করার কোনো যুক্তি আছে কি? আসলে বাংলা ভাষার বিরোধিতাকারীরা সব আমলেই সক্রিয় ছিল। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাই বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন- ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী/ সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মন না জুড়ায় নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়।’
১৬২০ সালে নোয়াখালীতে জন্ম নেওয়া এই কবির ওপরের চারটি পঙ্ক্তি বাংলা ভাষাপ্রেমীদের জন্য আজও অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এ ছাড়া, বাউল কবি লালন সাঁইজির ‘শিখবি যদি আরবি বুলি বাংলা নেওগে পাস করি’ এই কাব্য বাণী বাংলা ভাষার সপক্ষে অবিস্মরণীয়। তার এ গানটি বাংলা সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ। লালনেরই প্রশিষ্য পর্যায়ের আরেক সাধক মহিম শাহও (১৯০৩-১৯৯৬) ভাষা নিয়ে দারুণ লিখেছেন। ‘আ-মরি বাংলা ভাষা/ মা বলা ডাক মধুর লাগে/মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে/মা মা বোলে পুলক জাগে’। বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই বছর ১৬ আগস্ট বাংলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাজন করা হয়। এ দিনই রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক/পুণ্য হউক হে ভগবান’। শিক্ষা নিয়ে বিশেষত ভাষা নিয়ে যারা ভাবেন, তারা নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা ও উপেক্ষার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছেন। অধিকাংশ বিদ্যাপীঠে আজও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলা পঠন-পাঠন। ‘ভাষা’ শব্দটি উচ্চারণ করতে গেলে দাঁত ভাঙার উপক্রম হয়, এমন শিক্ষকও বাংলা পড়ান। এ আমাদের ভাষার দীনতা নয়, আমাদের শিক্ষক নির্বাচকদের অযোগ্যতার ফল।
দেশ যদি হয় মা, ভাষা তবে সেই মায়ের মুখেরই বোল। সেই ভাষার এত অবমাননা মেনে নেওয়া যায় কি?
লেখক : সংগীতশিল্পী ও সাংবাদিক
sajedfatemi1973@gmail.com